তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পররাষ্ট্রনীতির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি দেশে ফিরে আসার পূর্বে ভুটান ও ভারত ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ । পাকিস্তান ও তার মিত্রদের বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণায় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র তখনও বিভ্রান্ত । অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-সহযোগিতা লাভ জরুরি হয়ে পড়ে । বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও মেধা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে দুইটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে ।
প্রথমত : স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা । দ্বিতীয়ত: দেশ পুনর্গঠনে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা নিশ্চিত করা।
নবীন রাষ্ট্রটির পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকের ভূমিকার ছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। তিনি সব সময় স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির কথা বলেছেন। তিনি পররাষ্ট্রনীতির দিক-নিদের্শনা দিতে গিয়ে বলেন, 'আমরা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। ১৯৭২ সালের সংবিধানে পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখার বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হলো, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের পক্ষে থাকবে বাংলাদেশ ।
বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায়ের কাজটি খুব সহজসাধ্য ছিল না। কারণ, পাকিস্তানের বৈরী প্রচারণায় মুসলিম বিশ্বসহ চীন বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করত। বঙ্গবন্ধুর সকল নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ও জাতিসংঘসহ প্রায় সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি লাভ করে । সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে যোগদান করে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দেন। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা লাভ করে নতুন মর্যাদা। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। দেশ দুইটি হলো চীন ও সৌদি আরব। দুইটি দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বঙ্গবন্ধু আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। চীন ধীরে ধীরে বাংলাদেশ বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে শুরু করে। স্বীকৃতি না দিলেও চীন বাণিজ্যিক চুক্তি করে এবং বন্যার্তদের জন্য বাংলাদেশে সাহায্য প্রেরণ করে।
অন্যদিকে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভের মধ্য দিয়ে বহু সংখ্যক মুসলিম দেশের সমর্থন অর্জন করে। যদিও সৌদি আরব স্বীকৃতি দেয়নি। তথাপি কুটনৈতিক যোগাযোগের ফলে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সুতরাং, ঘটনাপ্রবাহের বিবেচনায় বলা যায়, চীন ও সৌদি আরবের স্বীকৃতি কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র । বঙ্গবন্ধু সরকার বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পুণর্গঠনের সংগ্রামে ভারত সরকার বিমান, জাহাজ থেকে শুরু করে খাদ্যশস্য, পেট্রোলিয়াম ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সাহায্য ও অনুদান হিসেবে প্রদান করে। ১৯৭২ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রাপ্ত বিদেশি সাহায্যের শতকরা ৬৭ দশমিক ০১ ভাগ প্রদান করে ভারত। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতীয় সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশকে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় থেকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। তৃতীয় বিশ্বের বিদেশি সাহায্য গ্রহণকারী একটি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে বিপুল পরিমাপ সাহায্য প্রদান করে ।
কিন্তু বাংলাদেশের চাহিদা ছিল আরও অনেক বেশি। ভারতের সাধ্যের মধ্যে এই চাহিদা পূরণ সম্ভব ছিল না । অধিক অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য সরকারকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে । পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য পুঁজিবাদী ও মুসলিম দেশগুলোর ওপর অধিক নির্ভর করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় বঙ্গবন্ধু সরকার প্রথম দিকে মার্কিন সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় । বঙ্গবন্ধু সরকার দেশের স্বার্থে পুঁজিবাদী ও মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল । তারপরও বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৩০টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করে । এ ছাড়া জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ ও ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদসহ ১৪টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করে ।
আরও দেখুন...